এনরনের উত্থান ও পতন: এক কর্পোরেট ট্র্যাজেডি
হঠাৎ দুর্দান্ত উত্থান
১৯৮৫ সালে, দুটি প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন কোম্পানি একত্রিত হয়ে গঠন করেছিল Enron Corporation, যার প্রধান কার্যালয় ছিল হিউস্টন, টেক্সাসে। কেনেথ লে (Kenneth Lay) ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি বাজারের deregulation-কে কাজে লাগিয়ে এক নতুন ধরণের শক্তি কোম্পানির যাত্রা শুরু করেন।
প্রথম দিকে এনরন ছিল একটি গ্যাস পরিবহন ও পাইপলাইনের ব্যবসা। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে জেফরি স্কিলিং (Jeffrey Skilling) কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পর একটি নতুন পথ ধরল এনরন। স্কিলিং এনরনকে একটি ট্রেডিং কোম্পানিতে রূপান্তর করেন, যা শক্তি (energy) কে একটি পণ্য হিসেবে লেনদেন শুরু করে।
এনরন হয়ে উঠল শক্তি বাজারের “ইনোভেশন আইকন”। একে Fortune ম্যাগাজিন ৬ বছর ধরে “America’s Most Innovative Company” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
মিথ্যার উপর দাঁড়ানো বিজনেস মডেল
কিন্তু এই সফলতার পেছনে ছিল ধোঁকাবাজি ও হিসাবের কারসাজি।
এনরন তার প্রকৃত মুনাফার চেয়ে অনেক বেশি দেখাতে শুরু করে “mark-to-market accounting” পদ্ধতির মাধ্যমে। অর্থাৎ, একটি চুক্তি থেকে ভবিষ্যতে যে আয় আসবে তা কোম্পানি তৎক্ষণাৎ আয় হিসেবে দেখাত, যেন সেই অর্থ ইতিমধ্যেই এসেছে।
এছাড়া, Andrew Fastow নামের সিএফও (CFO) অসংখ্য স্পেশাল পারপাস এন্টিটি (SPE) তৈরি করেছিলেন — এগুলো ছিল শেল কোম্পানি বা কাগজে থাকা কোম্পানি, যেখানে এনরনের ঋণ লুকিয়ে রাখা হত। SPE গুলোর নাম ছিল যেমন Chewco, LJM, Raptor, ইত্যাদি।
এসব ব্যবস্থার ফলে এনরনের হিসাব দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে কোম্পানির ভিতরে কী চলছে।
প্রতারণার মুখোশ খুলে গেল
২০০১ সালের শেষ দিকে সন্দেহ শুরু হয়। বিশ্লেষক ও সাংবাদিকরা এনরনের আর্থিক প্রতিবেদনে অস্বচ্ছতা দেখতে পান।
১৬ অক্টোবর, ২০০১, এনরন ঘোষণা করে যে তারা ৬১৮ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিতে পড়েছে, এবং ১.২ বিলিয়ন ডলার শেয়ারহোল্ডার ইকুইটি কমে গেছে তাদের SPE ব্যবস্থার কারণে।
পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য: অসংখ্য প্রতারণা, গোপন ঋণ, এবং আর্থিক প্রতিবেদনে মিথ্যা তথ্য।
এনরনের শেয়ার মূল্য, যা এক সময় ৯০ ডলার ছিল, দ্রুত নেমে আসে ১ ডলারের নিচে।
২ ডিসেম্বর, ২০০১, এনরন দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করে — যা তখন পর্যন্ত মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট দেউলিয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়।
হাজার হাজার কর্মী তাদের চাকরি এবং পেনশন হারান। বিনিয়োগকারীরা প্রায় ৭৪ বিলিয়ন ডলার হারান।
বিচার ও ফলাফল
এনরনের পতনের পর শুরু হয় তদন্ত ও বিচারের পালা:
• জেফরি স্কিলিং-কে ১৯টি প্রতারণার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, এবং তাকে ২৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় (পরে কিছুটা কমানো হয়)।
• কেনেথ লে-কেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়, কিন্তু সাজা ঘোষণার আগে তিনি মারা যান।
• অ্যান্ড্রু ফাস্টো স্বীকারোক্তিমূলক সাক্ষ্য দিয়ে ৬ বছরের জেল খাটেন।
এই কেলেঙ্কারিতে Arthur Andersen, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অডিট ফার্মগুলোর একটি, ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ তারা এনরনের হিসাব সংক্রান্ত নথি নষ্ট করে ফেলেছিল।
আইন ও সংস্কার
এই কেলেঙ্কারির জবাবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০০২ সালে Sarbanes-Oxley Act পাস করে:
• কর্পোরেট রিপোর্টিং ও অডিটের নিয়ন্ত্রণ জোরদার হয়
• প্রতারণার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়
• পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়
এনরনের গল্প কর্পোরেট লোভ, নৈতিকতার অবক্ষয় এবং ব্যালান্স না থাকার ফলাফল হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়।
এই কেলেঙ্কারি নিয়ে তৈরি হয়েছে ডকুমেন্টারি (Enron: The Smartest Guys in the Room), বহু বই, এবং শত শত বিজনেস স্কুল কেস স্টাডি।
শিক্ষণীয় বিষয়
এনরন আমাদের শেখায় — শুধুমাত্র ইনোভেশন নয়, বরং স্বচ্ছতা, সততা এবং জবাবদিহিতা একটি প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার মূল চাবিকাঠি।
Best Regards,
Invensef
(Invensef Media is a concern of Invensef Group)
#Enron
#enroncorporation
#FinancialScam